সর্বজনীন ঘোষণাপত্র

১. আমরা কুরআন পাঠক এবং কুরআনের অনুসারীরা মনে করি, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলদের এবং তাঁর কিতাব- কুরআনে বিশ্বাস করেন এবং কুরআনকে তার জীবনের পথ নির্দেশ হিসাবে গ্রহণ করতে চান- যা একজন প্রকৃত মুসলিমের জন্য অপরিহার্য, তারা নিজেরা নিয়মিত কুরআন পাঠ করবেন ও কুরআনে যা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে নিজেরা জানবেন এবং সেখানে যে পথনির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা যথাযথভাবে অনুসরণের চেষ্টা করবেন। এর মাধ্যমে তিনি তার নিজের করণীয় সম্পর্কে নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন। এভাবে একজন কুরআন পাঠক জ্ঞানের জগতে নিজেকে ক্ষমতায়ন (Empowerment) করতে সক্ষম হবেন, একই সাথে সামাজিক বিষয়ে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজেকে যোগ্য অংশীদার করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারবেন।

২. একজন কুরআন পাঠক নিজে কুরআন পাঠ করে কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও উপদেশ সম্পর্কে জানার পর ইসলামের প্রকৃত বিধি-বিধান, ন্যায়-নীতি, মুল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়ে সহজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবেন। ফলে কুরআনের বিধি-বিধান বা ইসলাম সম্পর্কে- ধর্মের পক্ষে বা ধর্মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজন, বিভিন্ন উদ্দেশ্যে যে সকল অসত্য বিকৃত প্রচারণা চালাচ্ছে, যার মাধ্যমে তারা সাধারণ মানুষকে প্রতারণার শিকার করছে, একজন কুরআন পাঠক সহজেই সে সব বিষয়ে সচেতন হতে পারবেন এবং এই প্রতারণা থেকে নিজেকে এবং নিজের পরিবার ও সমাজকে রক্ষা করতে পারবেন।

৩. একজন কুরআন পাঠক কুরআনের হাদিসে প্রকৃত বিশ্বাসী হলে তিনি কুরআনের সত্য জানার পর অবশ্যই সেখানে বর্ণিত মূল্যবোধগুলো ধারণ করার চেষ্টা করবেন। এভাবে তিনি সে মূল্যবোধগুলো তার নিজের জীবনে ও তার পরিবারে এবং সমাজে প্রতিফলন করতে পারবেন এবং তারই অংশ হিসাবে তিনি তা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নিজের করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

৪. একজন কুরআন পাঠক তার করণীয় সম্পর্কে যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন নিশ্চয়ই তিনি একই মূল্যবোধে দীক্ষিত অন্যান্যদের সাথে সংযুক্ত হতে চাইবেন এবং এভাবে সমাজের অন্যান্য কুরআন পাঠকের সাথে সংযুক্তি প্রক্রিয়ায় পরস্পর মত বিনিময় বা পরামর্শের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন এবং সম্মিলিতভাবে তারা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী অংশীদার (Stakeholder) হিসেবে আবির্ভুত হতে পারবেন। এর মাধ্যমে কুরআনের এইসব মূল্যবোধ- যেমন ভাল কাজে আদেশ এবং মন্দ কাজে নিষেধ করাসহ সমাজের অন্যায় অবিচার রোধে করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সম্মিলিত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।

৫. আমরা মনে করি, উল্লিখিত প্রক্রিয়া চলমান রাখার ক্ষেত্রে বাক স্বাধীনতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। শুধুমাত্র প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে কুরআনের সার্বজনীন মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে রাষ্ট্র ও সমাজে কুরআনের শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সর্বক্ষেত্রে বাক স্বাধীনতা অপরিহার্য। শান্তিপূর্ণভাবে সমাজে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে সর্বজনীন মূল্যবোধের চর্চ্চা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাক স্বাধীনতার বিকল্প নেই। শুধু বাক স্বাধীনতার মাধ্যমেই বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের পক্ষে কল্যাণকর শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ সম্ভব। এভাবেই পরস্পর বিরোধী চিন্তার শান্তিপূর্ণ মিথস্ক্রিয়ায় একটি উত্তম চিন্তার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব এবং এর মাধ্যমে কল্যাণমূলক সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যা বস্তুত কুরআনে বার্ণিত উত্তম মূল্যবোধের প্রতিফলন। সুতরাং আমরা বাক স্বাধীনতার পক্ষে সর্বদা সোচ্চার কণ্ঠ থাকতে চাই। আমরা মনে করি, শান্তিপূর্ণ প্রচারণা প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়া বা কোনো পক্ষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হলে সেটি যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।

৬. আমরা কুরআন পাঠকরা জানি যে, দ্বীন-ধর্মে জোর-জবরদস্তি নেই। এমনকি আল্লাহকে, তাঁর রাসুলদেরকে অথবা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কেউ যদি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, সে ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, সেখান থেকে সরে যাওয়া- সেটা উপেক্ষা করে উত্তম পন্থায় প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া (৪:১৪০, ৬:৬৮)। কুরআনের মুল্যবোধ হচ্ছে, ধর্মচর্চ্চার ক্ষেত্রে এই পৃথিবীতে প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা রয়েছে। যে ইচ্ছা করবে সে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং তা পালন করবে। রাসূলের দায়িত্ব পৌঁছে দেয়া বা প্রচার করা। বহুপূর্বে কুরআনের উদ্ধৃত এসব মূল্যবোধ এখন সর্বজনীন মুল্যবোধ হিসাবে সারা বিশ্ব গ্রহণ করেছে। এমন কি জাতিসংঘ মানবধিকার চার্টারেও এসব মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

৭. একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে ন্যায়বিচার অপরিহার্য অংশ। একটি সমাজে বা রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হলে সে রাষ্ট্রে হানাহানি, মারামারি, ঘুষ-দুর্নীতি, চুরিসহ সকল প্রকার অপরাধ দূরীভুত হতে বাধ্য। দল-মত বা পূর্ব শত্রুতার কারণে বিদ্বেষবশত: অথবা নিকটজনের প্রতি ভালোবাসা বা আবেগ-অনুরাগবশত: ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কাউকে অসমভাবে বিবেচনা করা বা কোন প্রভাব বিস্তার করা পবিত্র কুরআনে নিষিদ্ধ। বিচারের ক্ষেত্রে সত্য প্রতিষ্ঠায় কুরআন খুবই কঠোর, আপোষহীন (৪:১৩৫)। কুরআনে তার বহু স্পষ্ট নির্দেশ আছে। সুতরাং কুরআনের মূল্যবোধ অনুযায়ী ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ-জাত বা মতবাদ বা পূর্ব শত্রুতার কারণে বিচারপ্রার্থীর প্রতি বিভেদ করা যাবে না। বহু পূর্বে মানবজাতির জন্য এ মূল্যবোধ নাজিল হয়েছে। এখন তা বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন মূল্যবোধ হিসাবে গৃহীত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচারের সংজ্ঞায় এর কোন ব্যতিক্রম নেই। আমরা মনে করি, কুরআনের নিয়মিত পাঠকরাও কুরআনের এই মুল্যবোধে দীক্ষিত হয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবেন। এক্ষত্রে তারা ন্যায়বিচারের রক্ষাকবচ হিসাবে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে পারবেন।

৮. পবিত্র কুরআনে খুবই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে – যার যার কর্মের ফলাফল তার নিজের। সে ভাল হলে তার কর্মের পুরস্কার তারই, সে মন্দ হলে তার দায়-দায়িত্ব তারই। সুতরাং পিতার কর্মের দায়ে যেমন তার সন্তানদের শাস্তি দেওয়া যায় না, একইভাবে পিতার কর্মের কৃতিত্বের উত্তরাধিকারিত্বও তার সন্তানরা দাবী করে বিশেষ সুবিধা গ্রহণের সুযোগ আল-কুরআনে নেই। সুতরাং যার যার কর্মের দায় কেবল তারই। এটি এখন সভ্য সমাজে সর্বজনীন মুল্যবোধ হিসাবে গৃহীত হয়েছে। এ মূল্যবোধের উত্তম চর্চ্চা এক কল্যাণকর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম উপাদান।

৯. উপর্যুক্ত মূল্যবোধগুলো যা কুরআনে শ্বাশত শিক্ষার অংশ, যা দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ন্যায় ও ইনসাফের মানদন্ড হিসাবে মানব জাতি গ্রহণ করেছে এবং যা বিশ্বব্যাপী উত্তম পন্থা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে- আমরা মনে করি, ‘কুরআন পাঠ আন্দোলন’-এর মাধ্যমে এ প্রক্রিয়াকে আরো বেগবান করার মাধ্যমে সেটি অধিক উত্তমভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব এবং এভাবেই বিশ্বব্যাপী একটি কল্যাণকর সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমরা সক্ষম হব।