Back

মাতৃভাষা বাংলায় কুরআন অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা

Quran in Mother Language

মহান আল্লাহ এই পৃথিবীতে মানুষ প্রেরণ করেছেন তার প্রতিনিধি হিসেবে এবং সেই সাথে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা হিসেবে দিয়েছেন জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা, মেধা শক্তি, বিবেক বুদ্ধি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, কর্মদক্ষতা অর্জনের প্রবণতা, ইচ্ছা শক্তি এবং সর্বোপরি এই ক্ষমতা গুলো প্রকাশ ও সমন্বয়ের ভাষা। এগুলো কেবল কিছু মৌলিক ক্ষমতা যা মানুষকে দেয়া হয়েছে প্রকৃতিগতভাবে। কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এই ক্ষমতাগুলো যথেষ্ট নয়। বরং এই ক্ষমতা গুলো চর্চা ও সেসবের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব অর্জন করতে পারে। আর তাই মহান আল্লাহ কালের আবহে তার মনোনীত বার্তাবাহকদের মাধ্যমে মানুষের নিকট উপস্থাপন করেছেন অসংখ্য নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ যা মানুষকে ইহকাল ও পরকালীন মুক্তির পথ প্রদর্শন করে। আর সেই ঐশী বাণী যখন মনুষ্য ভাষায়, দুই মলাটের ভাজে স্থান করে নেয় তখন তা হয়ে ওঠে এক মহাগ্রন্থ। কালের পরিক্রমায় আমরা তেমনই একটি মহাগ্রন্থের ধারক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি, যার নাম আল কুরআন।

পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। (৯৬/১)
উক্ত আয়াতটি সেই মহাগ্রন্থ আল কুরআন থেকেই চয়ন করা হয়েছে যার মাধ্যমে মহান আল্লাহ সমগ্র মানবজাতিকে (২৫:১, ৩৪:২৮, ২১:১০৭, ৭:১৫৮) তার ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআন পড়ার আদেশ প্রদান করেছেন। এর উদ্দেশ্য বর্ণনায় আল কুরআনের স্বচ্ছ ও নির্মল ভাষায় দয়াময় আল্লাহ্‌ বলেন, “যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায় এই কিতাব (আল কুরআন) দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন, এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং সুদৃঢ় পথে পরিচালনা করেন।” (৫/১৬)

এখানে লক্ষ্যনীয় যে, যেহেতু মহান আল্লাহ পুরো মানবজাতির জন্যই এই কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই এর ভাষা (আরবি) কোন ভাবেই মানুষকে পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেকে ব্যহত করতে পারে না। ভাষা কি জিনিস? এক কথায়, যোগাযোগের সুশৃংখল ও অর্থবোধক মাধ্যম। আর এই মাধ্যমটিকেই মহান আল্লাহ প্রকাশ করেছেন একটি বড় নিদর্শন হিসেবে (৩০/২২)।

বলা বাহুল্য যে, সব রাসূলদের ভাষা আরবী ছিল না। এ প্রসঙ্গে করুণাময় আল্লাহ বলেন “আমি প্রত্যেক রসূলকে তার স্বজাতির ভাষা নিয়ে (ভাষাভাষী করে) পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে (আল্লাহর বার্তা) সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করতে পারে, …..” (১৪/৪)।

অর্থাৎ প্রত্যেক রাসূলের জাতির নিকট সেই ভাষারই একজন রাসূল নিয়োগ করেছেন। এই আয়াত থেকেই রাসূলদের নিজ নিজ ভাষায় ঐশীগ্রন্থ পাঠ ও তার চর্চার গুরুত্ব ফুটে উঠে। আল কুরআন একটি সার্বজনীন ঐশীগ্রন্থ যা কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় থেকে কেয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের জন্য মহা স্মরণিকা। নিঃসন্দেহে, যে কেউ আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারলে আল কুরআন বোঝা তার জন্য তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু নিশ্চয়তা কেবল আল্লাহই দিতে পারেন। বিশ্বায়নের এই যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যে উত্তরোত্তর উন্নতি সাধনের জন্য আমরা ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করি এবং এটাকেই আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করি। ঠিক একই রকম ভাবে আল কুরআনের মর্ম বাণী গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য আল কুরআনের ভাষা আরবি শেখা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু তার মানে এই নয় যে যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি এই ভাষা সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থ না বুঝেই অন্ধের মতো আল কুরআন আবৃত্তি করে যাবেন। অন্যভাবে বলা যায়, আরবি ভাষার অদক্ষতা কোনভাবেই আল কুরআন অধ্যয়ন এবং তা নিয়ে চিন্তা গবেষণা করার পথে প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না। আর এটাই আল্লাহ সচেতন বিশ্বাসী মানুষের জন্য সবচেয়ে নির্ভুল ও বিশ্বস্ত সূত্র হিসেবে আল কুরআনের সৌন্দর্য্য।

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, মাতৃভাষায় কুরআন অধ্যয়ন যদি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে পৃথিবীতে কোটি কোটি মুসলিম জনসংখ্যা কেন তাদের মাতৃভাষায় আল কুরআন অধ্যয়ন করে না? সমস্যা কোথায়?

এর উত্তরটা সহজ হলেও এই সহজ উত্তরটাই আমরা উপলব্ধি করি না। একজন মুসলিম হিসেবে আপনার যেমন প্রধান দায়িত্ব নিয়মিত মাতৃভাষায় আল কুরআন পড়ে ইহকাল ও পরকালের মুক্তি নিশ্চিত করা, ঠিক তেমনি শয়তানের একমাত্র কাজ হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখা। নিঃসন্দেহে শয়তান আমাদের চাইতে বেশি দায়িত্ববান। সে যে করেই হোক আপনাকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখবে। সে ভালো করেই জানে যে মানুষের অন্তরে আল্লাহর স্মরণ প্রতিষ্ঠিত হয় আল্লাহর ঐশী বাণীর মাধ্যমে। আর তাই সে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় আল্লাহর ঐশী বাণীর সাথে আপনার বিচ্ছিন্নতা ঘটানোর। তার এই মিশন শুরু হয় মানুষকে আল কুরআন এর উপর ঈমান হারা করার মাধ্যমে। কীভাবে বুঝলাম? আপনিও বুঝতে পারবেন মাতৃভাষায় আল কুরআন অধ্যয়ন শুরু করলে। কারণ মহান আল্লাহ আমাদেরকে আল কুরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন যে শয়তানের চক্রান্ত অত্যন্ত দুর্বল (৪/৭৬)।

মহান আল্লাহ বলেন, “আমি যাদেরকে ঐশীগ্রন্থ/কিতাব দিয়েছি, (তাদের মধ্যে) যারা তা যথার্থভাবে পাঠ করে (কেবল) তারাই তা (পূর্ণাঙ্গ ভাবে) বিশ্বাস করে। আর যারা তা অবিশ্বাস করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। (২/১২১)”।

অর্থাৎ যথার্থভাবে পাঠ/হকের সাথে তিলাওয়াত না করা হলে ঐশীগ্রন্থ/কিতাবের উপর ঈমানই থাকে না। আল কুরআন যথার্থভাবে পাঠের শর্ত হল ৪টি, ১) নিয়মিত বুঝে বুঝে আল কুরআন পাঠ করা, ২) আল কুরআন এর আয়াত নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা গবেষণা করা, ৩) ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আল কুরআনের নির্দেশনা প্রতিষ্ঠা করা। ৪) অন্যকে আল কুরআন সম্পর্কে সচেতন করা (অর্থাৎ কোন আয়াত গোপন না করে আল কুরআন প্রচার করা)।

এই চারটি হকের কোনোটিই করা সম্ভব নয় যদি আপনি না বুঝে আল কুরআন আবৃত্তি করেন। এই আয়াতটি একটি নিরীক্ষা মূলক আয়াত, যা আমাদের বর্তমান সমাজের অধিকাংশ মুসলিমেরই ঈমান প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে। কারণ এসব নামধারী মুসলিম না আল কুরআনের আয়াত বুঝে বুঝে পড়ে না তা নিয়ে গভীর চিন্তা গবেষণা করে। তাদেরকে মহান আল্লাহ একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, “তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? (৪৭/২৪)।” আল-কুরআন পাঠ ও অধ্যায়নের জন্য আল কুরআনে মোট তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে করআ, তিলাওয়া এবং রাতাল কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এগুলোর কোনটারই অর্থ ‘না বুঝে পড়া নয়’। ভেবে দেখুন, বিনোদনের জন্য হলেও আমরা অর্থ ছাড়া গল্পের বই কেনেন না বা পড়েনও না। কিন্তু আল কুরআন এর বেলায় আমাদের নীতি পরিবর্তন হয়ে যায় কেনো?

সে যাই হোক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনার নিকট শয়তানের দুর্বল চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেছে। সে চায় না কখনোই আপনি মাতৃভাষায় আল কুরআন বুঝে বুঝে পড়ুন, সে কখনো চায় না কোরআন পড়ে আপনার অন্তর ভিজে যাক, চক্ষু হোক অশ্রুসিক্ত, অন্তর হোক বিগলিত। সে চায় আমরা সবাই বনি ইসরাইল জাতির মত পুস্তক বহন করা গাধায় (৬২/৫) পরিণত হই। সে চায় আল কুরআন পরিত্যক্ত করে ফেলেন (২৫/৩০), সে চায় আপনি না বুঝে সুরে সুরে কোরআন আবৃত্তি করুন এবং কুরআন নিয়ে মিথ্যা আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকুন (২/৭৮) এবং এভাবেই একদিন কবরে চলে যান। আর ওর জন্য এসবই সম্ভব যদি আপনাকে আল কুরআন থেকে তুলে রাখতে পারে।

যদি মনে করে থাকেন শয়তান একাই এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে তাহলে ভুল ভেবে বসে আছেন। শয়তান তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে অসংখ্য প্রতিনিধি (এজেন্ট) নিয়োগ করেছে এবং নিয়মিত তাদের পরামর্শও দিয়ে থাকে। এ প্রসংগে মহান আল্লাহ বলেন,

“নিশ্চয়ই শয়তান তার বন্ধুদের কাছে ওয়াহী করে, তারা যেন তোমাদের সাথে তর্ক করে। (সাবধান!) যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো, তাহলে তোমরাও মুশরেক হয়ে যাবে” (৬/১২১) ।

কি? এদের চেনা চেনা লাগছে? লাগারই কথা কেননা, শয়তান আমাদের প্রকাশ্য/সুস্পষ্ট শত্রু (২/১৬৮, ২০৮; ৬/১৪২; ৭/২২; ১২/৫; ১৭/৫৩; ৩৬/৬০; ৪৩/৬২)। দিনশেষে এরা সবাই মিলে সুকৌশলে শয়তানের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছে।

এমন টা কিন্তু একদিনে হয়নি, ধীরে ধীরে আপনার মনস্তাত্বিক জগতে এরা প্রয়োজনীয় সব ধরণের আগাছা জন্মিয়েছে। এরাই তারা যারা ছোট ছোটবেলা থেকেই আপনাকে শিখিয়েছে যে আল কুরআন বোঝা অত সহজ নয় অনেক কঠিন অনেক ধরনের জ্ঞানের প্রয়োজন আল কোরআন বুঝতে। না বুঝে আল কুরআন আবৃত্তি করলে কল্যাণ রয়েছে। এরা কখনোই আপনাকে আল কুরআনের সরলতা সম্পর্কে জানায়নি। অথচ মহান আল্লাহ বলেন,
“আর আমি তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব কোন উপদেশ গ্রহনকারী কেউ আছে কি? (৫৪/১৭, ২২, ৩২, ৪০)”

দয়াময় আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন অনুসরণ করতে বলেছেন (৭/৩) কারণ নিশ্চয়ই এ কুরআন সর্বাধিক সরল পথ প্রদর্শন করে (১৭/৯)। চাষি যেমন জমির আগাছা দূর করেই কেবল বীজ বপনের জন্য জমি তৈরি করে। ঠিক ঠিক তেমনি আল কুরআন অধ্যায়ন করার পূর্বে মাথা থেকে যাবতীয় দুশ্চিন্তা এবং যাবতীয় ভুল ধারনাগুলোকে দূর করতে হবে।

“সুতরাং যে আমার শাস্তির সতর্কীকরণকে ভয় করে তাকে কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দাও (৫০/৪৫)।” আল কুরআন এর পাঠক হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি আপনার অন্তরে মহান আল্লাহর ভয় বিদ্যমান রয়েছে আর তাই আপনাকে সতর্ক করলাম।

পরিশেষে বলবো, শয়তানের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিন। আল কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন করুন। এবং আজ, এখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিন যে মৃত্যুর আগে অন্তত একবার মাতৃভাষায় পুরো কুরআনটা বুঝে বুঝে পড়বেন। মনে রাখবেন আল কুরআন আল্লাহ সহজ করে দিয়েছেন উপদেশ গ্রহণের জন্য এবং তিনিই এর একমাত্র শিক্ষক।

believer
believer
https://quranpathandolan.org

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *