Back

বাঙালি মুসলমানের মনস্তত্ত্ব

“ঈমানের সাথে মৃ্‌ত্যু” নয়; বরং মুসলিম হয়ে মৃ্‌ত্যুবরণ করতে হবে!
 
বাঙালি মুসলমানের মনস্তত্ত্ব গঠন এবং তার উপর ভিত্তি করে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবন পরিচালনায় ধর্মীয় বিশ্বাস অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। সেই বিচারে সিংগভাগ বাঙালি মুসলমানের মন ও মনন কলূষিত। আমরা আজ একটি অনুষঙ্গ নিয়ে কথা বলব। যারা মসজিদের মিম্বর বা ওয়াজের মঞ্চ থেকে আমজনতাকে ধর্ম শেখায়, তারা একটি কথা হরহামেশা বলে থাকে, বিশেষ করে সকল মোনাজাতের শেষে, আল্লাহ যেন আমাদের ঈমানের সাথে মৃত্যু দান করেন। সেই শিক্ষা থেকে আমরাও অভ্যাসবশত বলি, “দোয়া করবেন, যেন ঈমানের সাথে মৃত্যু হয়”। মোদ্দাকথা, “ঈমানের সাথে মৃত্যু” ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়।
 
কিন্তু কুরআনের দাবী হল, আমরা যেন মুসলিম না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ না করি – কুরআনী এই নির্দেশকে “ঈমানের সাথে মৃত্যুর” আপাতত সুন্দর বচন দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। মুখে শুধু ঈমানের ঘোষণা দেয়া আর মুসলিম হওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। কুরআন ঈমানের উর্ধে মুসলিম হওয়ার সাথে মৃত্যুকে যুক্ত করেছে।
 
কেননা ফেরাউনও মৃত্যুর সময় ঈমানের ঘোষণা দিয়েছিল – আনা মিনাল মুসলিমীন।
آَمَنْتُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا الَّذِي آَمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ
আমি ঈমান আনি যে কোন মাবুদ নেই তাঁকে ছাড়া যাঁর উপর ঈমান এনেছে বনী-ইসরাঈলরা, আর আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত। -১০:৯০
 
কিন্তু ঈমানের সাথে মৃত্যু তার কোন কাজে আসেনি। শেষ মুহূর্তে তওবা বা ঈমান আনার কোন মূল্যই নেই-
هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا أَنْ تَأْتِيَهُمُ الْمَلَائِكَةُ أَوْ يَأْتِيَ رَبُّكَ أَوْ يَأْتِيَ بَعْضُ آَيَاتِ رَبِّكَ يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آَيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آَمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا قُلِ انْتَظِرُوا إِنَّا مُنْتَظِرُونَ
তারা কি প্রতীক্ষা করছে ফিরিশতারা তাদের কাছে আসুক, অথবা তোমার প্রভু আসুন, অথবা তোমার প্রভুর কোনো কোনো নিদর্শন আসুক, তখন কোনো লোকেরই তার ঈমানে কোনো ফায়দা হবে না যে এর আগে বিশ্বাস স্থাপন করে নি, কিংবা যে তার ঈমানের দ্বারা কোনো কল্যাণ অর্জন করে নি। বলো- তোমরা অপেক্ষা করো, আমরাও প্রতীক্ষাকারী। -৬:১৫৮
 
وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآَنَ
আর তওবা তাদের জন্য নয় যারা কুকর্ম করেই চলে, যে পর্যন্ত না মৃত্যু তাদের কারও কাছে হাজির হলে সে বলে- আমি অবশ্যই এখন তওবা করছি। -৪:১৮
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বের ঈমান আনয়ন বা তওবা একজনের জন্য কোন কাজেই আসবে না।
 
বরং আমরা উত্তম আদর্শ নবী ইউসূফের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বলব- تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ
হে আল্লাহ তুমি আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দাও এবং আমাকে সৎকর্মীদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত কর। -১২:১০১
 
কেননা, আল্লাহ সেই হুকুমই আমাদের করেছেন, (৩:১০২) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। এবং অবশ্যই মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।
ছবরুন জামিল বা পরম ধৈর্যশীল নবী ইবরাহীম ও ইয়াকুব সেই একই নির্দেশ তাঁর সন্তানদের দিয়েছেন- (২:১৩২)
 
يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
হে আমার সন্তানগণ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এ ধর্মকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।
যাদুকরদের যে দল ফেরাউন জড়ো করেছিল, তারা যখন নবী মূসার আসল পরিচয় উপলব্ধি করে ঈমান আনল, তখন তারা প্রার্থনা করেছিল-
رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَتَوَفَّنَا مُسْلِمِينَ
হে আমাদের রব্ব, আমাদের জন্য ধৈর্য্যের দ্বার খুলে দাও এবং আমাদেরকে মুসলিম হিসাবে মৃত্যু দান কর। -৭:১২৬
 
কিয়ামতের দিন অপরাধিরা আফসোস করবে, যদি দুনিয়াতে তারা মুসলিম হত, (তারা বলবে না, যদি দুনিয়াতে আমরা ঈমান আনতাম)
رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمِينَ
সময়কালে যারা অবিশ্বাস করেছিল তারা চাইবে যে যদি তারা মুসলিম হতো! -১৫:২
 
প্রশ্ন হতে পারে, মুসলিম কীভাবে হওয়া যায়, সেটা নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা হতে পারে। এখানে আরও একটি ভ্রান্ত সম্পূরক বিশ্বাস আছে যে, যার অন্তরে বিন্দু পরিমান ঈমান আছে, সে অবশ্যই একদিন জান্নাতে প্রবেশ করবে – এটাও সম্পূর্ণ কুরআন বিরুদ্ধ কথা। আমরা অন্য কোনদিন তা নিয়ে কথা বলব, ইনশাআল্লাহ।
 
আমাদেরকে এখনই সতর্ক হতে হবে, যারা আমাদের মনজগতে এই ভ্রান্ত ও কপট বিশ্বাসের প্রাণঘাতি বিষ ঢুকিয়ে জাহান্নামের দিকে ধাবিত করছে, তাদের কথাকে কুরআন দিয়ে যাচাই করা। বাংলা ভূখন্ডের তৃণমূল পর্যায় থেকে একেবারে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিবর্গ মহামারী এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত – তাদের মধ্যে এক ধরণের দাম্ভিকতা আছে যে, আমরা কি বেহেশতে যাব না, আমাদের অন্তরে কি ঈমান নেই?
এই অপবিশ্বাস তাদের স্বেচ্ছাচারিতাসহ সকল দুর্বৃত্তপনা করতে একধরণের অবাধ লাইসেন্স প্রদান করে। মৃত্যুর সময় ঈমান বা অন্তরে ঈমানের সামান্য উপস্থিতি এবং তার উপর ভর করে একদিন জান্নাতে যেতে পারার সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বিশ্বাস তাকে পৃথিবীতে অমানুষে পরিণত করে। তার দ্বারা শোষণ, নিপীড়িণ, দুঃশাসন, দুর্নীতি, দুরাচার সবই সংঘটিত হয়- কেবলমাত্র এই জাতীয় কপট বিশ্বাস তার অবচেতনে সর্বদা কাজ করে বিধায়। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًا
নিশ্চয়ই যারা একবার ঈমান আনার পরে পুনরায় কাফের হয়, আবার ঈমান আনে এবং আবারো কাফের হয় এবং কুফরীতেই উন্নতি লাভ করে, আল্লাহ তাদেরকে কখনও ক্ষমা করবেন না, পথও দেখাবেন না। -৪:১৩৭
 
আর একেবারে শুরুতে তো আছেই (২:৮)। অতএব, ঈমানের সাথে মৃত্যুর মিথ্যা ধ্যান-ধারণা থেকে আমরা সতর্ক হই; আমরা যেন মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারি, সেই চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও দোয়া করি। সালামুন আলাইকুম।
—-
(আবু সাঈদ খান; ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২)

believer
believer
https://quranpathandolan.org

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *