আমরা অনেকেই এ জাতীয় ধারণা পোষণ করি যে, সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করে তাকে আমরা ভালোবাসব, সেখানে ভয়ের প্রশ্ন আসে কেন? আমি নিজেও একসময় এই প্রশ্ন করেছি।
প্রথমত, তাকওয়ার বাংলা প্রতিশব্দ কেবলমাত্র “ভয়” নয় – এখানে একইসাথে ভয়-ভক্তি, সতর্কতা, দায়িত্ব-সচেতনতা, বাধ্যতা, আনুগত্য জাতীয় অনেকগুলো উপাদান নিহিত আছে। তবে তাকওয়ার মধ্যে ভয় বা পরোয়া করার বিষয়টি মূখ্য। সৃষ্টি হিসেবে আমাদের অবশ্যই স্রষ্টার আদেশ-নিষেধকে মাথায় রেখে সতর্ক-সচেতন থাকতে হবে, যাতে করে আমরা সীমালংঘন না করি বা লাগামহীন আচরণ না করি। যে তেমনটি মেনে চলতে পারে, সেই সত্তাই কুরআনের দৃষ্টিতে মুত্তাকী; আর কুরআন হচ্ছে মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত।
দ্বিতীয়ত, সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসার বিষয়টি কুরআনে বহু আঙ্গিকে বলা হয়েছে।
সূরা বাকারা – আর কোন লোক এমনও রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী। -২:১৬৫
সূরা আল-ইমরান – বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল, দয়ালু। -৩:৩১
সূরা মায়িদা – হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। -৫:৫৪
তাই স্রষ্টাকে ভালোবাসার বিষয়টি আমাদের কাছে স্বয়ং তাঁরই দাবী। তবে পারস্পরিক এই ভালোবাসা মোটেই শর্তহীন নয়। আমরা আমাদের প্রিয় সন্তান থেকেও ভালোবাসা প্রত্যাহার করে নেব, যখন প্রমাণিত হবে যে, তারা বখে গেছে এবং পিতা-মাতার আদেশ-নিষেধের সম্পূর্ণ অবাধ্য হচ্ছে। অনুরূপভাবে আমি কাউকে ভালবাসি – এটা স্রেফ মুখে ঘোষণা বা দাবী করার বিষয় নয়। ঘোষণাটি যথার্থ ও সত্য দাবী কিনা, তার অনেক শর্ত ও দায়-দায়িত্ব রয়েছে। কর্তব্য সম্পন্ন সাপেক্ষেই ভালোবাসার ঘোষণা প্রতিষ্ঠিত হয়।
আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট মানুষের প্রতি সর্বোত্তম পর্যায়ে স্নেহশীল, তা পুরো কুরআনে বহু মাত্রায় বয়ান করা হয়েছে। আল্লাহ আমাদের ভালোবাসেন, তিনি তাঁর পক্ষ থেকে সেই স্নেহের সকল শর্তই পূরণ করেছেন। তিনি আমাদের সকল নেয়ামত দান করেছেন, যা যা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়, যা আমরা গুণে শেষ করতে পারব না। বহু অপরাধ করার পরও তিনি আমাদের ক্ষমা করে দেন যা আমরা জানিই না। তিনি অনেক অপরাধের জন্য আমাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে চলেন, নইলে পৃথিবীতে বিচরণশীল কেউ তিষ্ঠাতে পারত না।
সূরা শুরা – তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল; আর তিনি তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন। -৪২:৩০
সুতরাং এই যে ভালোবাসার যে সম্বন্ধ তিনি আমাদের সাথে রচনা করেছেন, তার মর্যাদা রক্ষা করতেই আমরা যেন সতর্ক-সাবধান থেকে স্রষ্টার পছন্দ, অপছন্দকে পরোয়া করে জীবনযাপন করি, সেসবই বলা হয়েছে ‘তাকওয়া’ সক্রান্ত আয়াতগুলোতে। যেন শেষবিচারে তিনি আমাদের প্রতি তাঁর চির কল্যাণ ও নেয়ামত দানের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেন। আর আমাদের দ্বারা এর ব্যত্যয় হলে আল্লাহর ঘোষিত আইন অনুযায়ীই আমরা ধিকৃত হব, চির শাস্তির যোগ্য হব। তখন আমরা এই অজুহাত দিতে পারব না যে, আল্লাহ অত্যন্ত করুণাময়, অতএব আমাদের ক্ষমা করুন।
সূরা কাফ – আল্লাহ বলবেনঃ আমার সামনে বাকবিতন্ডা করো না আমি তো পূর্বেই তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ভয় প্রদর্শন করেছিলাম। আমার কাছে কথা রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি জুলুমকারী নই। -৫০:২৮-২৯
সূরা যুমার – তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমূখী হও এবং তাঁর আজ্ঞাবহ হও তোমাদের কাছে আযাব আসার পূর্বে। এরপর তোমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না; তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ উত্তম বিষয়ের অনুসরণ কর তোমাদের কাছে অতর্কিতে ও অজ্ঞাতসারে আযাব আসার পূর্বে, যাতে কেউ না বলে, হায়, হায়, আল্লাহ সকাশে আমি কর্তব্যে অবহেলা করেছি এবং আমি ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। অথবা না বলে, আল্লাহ যদি আমাকে পথপ্রদর্শন করতেন, তবে অবশ্যই আমি পরহেযগারদের একজন হতাম। অথবা আযাব প্রত্যক্ষ করার সময় না বলে, যদি কোনরূপে একবার ফিরে যেতে পারি, তবে আমি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে যাব। -৩৯:৫৪-৫৮
এজন্যই কুরআনে বহু জায়গায় স্রষ্টাকে পূর্ণ সমীহ করে আনুগত্যশীল হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
بَلَى مَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ وَاتَّقَى فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ
হাঁ, যে কেউ তার অঙ্গীকার পালন করে ও ভয়-ভক্তি বজায় রেখে চলে, তবে নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন। -৩:৭৬
তাই আমরা যেন আমাদের হঠকারিতামূলক আচরণ দ্বারা নিজেরা আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত না হই, সে বিষয়ে সাবধান করাই আল্লাহকে ভয় বা পরোয়া করার মৌলিক উদ্দেশ্য বলে আমার ধারণা।
—–
(আবু সাঈদ খান; ২রা জানুয়ারী ২০২৪, মঙ্গলবার)